রবীন্দ্রনাথের 'অতিথি' গল্পের তারাপদ চরিত্র
‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ চরিত্র
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ চরিত্রটি বাংলা
সাহিত্যে একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ নানা মাত্রায় চরিত্রটিকে জীবন্ত
করেছেন, সম্পৃক্ত নানাবিধ জীবন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে। তারাপদ চরিত্রে রবীন্দ্রনাথ যে বৈশিষ্ট্য
সম্পৃক্ত করেছেন সেগুলি এমনভাবে সাজানো যেতে পারে—
১. তারাপদ সমস্ত প্রকার
মানব বন্ধনের বিপ্রতীপ মেরুর সৃষ্টি। কোনোপ্রকার মানব বন্ধনকে গ্রাহ্য করে
না সে।
২. মানুষ ও প্রকৃতি মিলে যে রহস্যময় জীবন প্রবাহকে সচল করে
রেখেছে তারাপদ সেই জীবনের প্রতীক। প্রকৃতির সঙ্গে সে নাড়ির টানের সম্পর্কে যুক্ত।
৩. তারাপদ বিশাল
প্রকৃতির অনাসক্ত রূপের প্রতীক। আসক্তি হীনতায় তারাপদকে চালিত করেছে।
৪. বিচিত্র পরিবেশ ও পটভূমি প্রেক্ষিতে যে ঋতু বদল প্রকৃতি
রাজ্যে ঘটে তার সমান্তরালে তারাপদ হয়ে উঠেছে চিরচঞ্চল।
৫. তারাপদর সঙ্গে বাস করে করে যেন একটি শিশু আত্মা, শিশুর
সারল্য নিয়ে জীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর তারাপদ।
৬. তারাপদ চির আতিথ্যের সংস্কারে সম্পৃক্ত। চলমান তার
প্রতীক। গতিশীল বিশ্বের সেও গতিবান অতিথি। তারাপদ আসলে বন্ধ অসহিষ্ণু চিরচঞ্চল
গতিশীল, যে কোনোপ্রকারের বন্ধন ছিন্নকারী বিপুল জীবন রহস্যের অতিথি সত্তার
পরিপূরক। তার মনকে টানছে মানুষের দিকে—বাইরের বড়ো রাস্তায়।
‘অতিথি’ গল্পের তারাপদর মাধ্যমে এই তত্ত্বসত্যের বাস্তবায়ন
দেখানো হয়েছে তারাপদ প্রকৃতির সন্তান স্বভাব বাউণ্ডুলে। মাটির টান তার নাড়ির
চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মানুষের যে বাঁধনের বিপরীত তার যাতায়াত।
বিপুলাময় এই প্রকৃতির কাছে মানুষের বাঁধন টেকে না তাই মানুষের বাঁধন পরাজিত হয়।
বিপুলাময় পৃথিবী যার বাসস্থান মানুষের মত তার বাসা রচনা করে কেমন করে? পারে না, এই
সত্যে তারাপদ সত্যিই অতিথি।
তারাপদ এই প্রকৃতির সত্তার জন্য বারে বারে মানুষের বাঁধাকে
ছিন্ন করেছে। প্রথমবার তারাপদ তার পারিবারিক স্নেহের বাঁধনটিকে ছিন্ন করেছে। পরে
ঘরের বাঁধন রূপ স্নেহ সিক্ত আকুলিত চিত্ত মায়ের কথা প্রসঙ্গে সে অনায়াসে জানিয়ে
দেয় “তার আরও চারটি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে আছে।” দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এক যাত্রা দলের
অধিকারীর স্নেহোচ্ছায়া থেকে পালিয়ে যায় তারাপদ। মানুষের বাঁধন ছিন্ন হয়ে পাঁচালি
গানের সুর সংগীতে মানবের কারণে। পাঁচালি দলে দলধ্যক্ষের বক্ষপিঞ্জর থেকে ব্যায়াম
নৈপুণ্যে জিমনাস্টিকের দলটিও তাদের মানব বন্ধন দিয়ে তারাপদকে ধরে রাখতে পারেনি।
ফের সে পালিয়ে যায় নন্দীগ্রামের জমিদার বাবুর যাত্রাদলে। শেষ
পর্যন্ত সে কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলাল বাবুর আশ্রয়ে হাজির হয়। সেখানে যখন তাকে
আত্মীয়ের বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা হতে লাগল তখন সে পালিয়ে গেল নাম না জানা কোনো এক
আশ্রয়ে।
তারাপদর এই যে স্থানান্তর গমন তার মূলে আছে তার মধ্যেকার অতিথিসত্তা। এ পৃথিবীর মানুষের একে অন্যের অতিথি মাত্র হতে পারে। কিন্তু এ পৃথিবীর প্রকৃতি লোকের ক্রোড়ভূমি মানুষের চিরকালের সম্পর্কের আশ্রয় হিসেবে চিহ্নিত। তারাপদ বারে বারে এই বাঁধন সে ছিন্ন করেছে তাই জন্ম থেকে সে বাউণ্ডুলে হয়েছে। যখন প্রকৃতির কোলে মানুষ বড়ো হয় তাকে চিনতে পারে তখন প্রকৃতির প্রভাব মানুষকে করে তোলে সৌন্দর্য পিপাসু। করে তোলে তুচ্ছ ক্ষুদ্র জীবন ভোগের বিপরীত। জগৎ ঐশ্বর্য সম্ভোগের ধারক পাত্র। জীবন উড়ান দেয় “মনকে টানছে মানুষের দিকে বাইরের বড়ো রাস্তায়” অতিথি গল্পে তারাপদ তার প্রমাণ। প্রকৃতি তাকে ধনী করেছে ঋদ্ধ করেছে, করেছে জীবনাভিসারের প্রতীক।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন


